🌧 পর্ব – ২ : হারিয়ে যাওয়া সময়
ঋষি আর মীনার দেখা হওয়ার পর যেন হাওয়ায় অন্যরকম গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। পোস্টঅফিসের ছোট্ট ঘরটায় তখন দুপুরের রোদ ঢুকছে জানালা দিয়ে, আর সেই রোদের ফাঁকে দাঁড়িয়ে তারা দু’জন — বছর দশেক পর মুখোমুখি।
মীনা থেমে থেমে বলল,
“তুমি সত্যিই ঋষি?”
ঋষি একটু হেসে মাথা নাড়ল,
“হ্যাঁ, অনেক দিন পর দেখা হল… তুমি একদম বদলে গেছ, মীনা।”
মীনা বলল না কিছু। শুধু একটা গভীর শ্বাস নিয়ে জানালার বাইরে তাকাল।
“তুমি কিন্তু কথা রাখোনি। বলেছিলে ফিরে আসবে।”

ঋষি একটু চুপ থেকে বলল,
“জীবন সব সময় কথা রাখতে দেয় না। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, পড়াশোনার চাপ, তারপর চাকরির দৌড়… কিন্তু আমি ভুলিনি, কখনো না।”
মীনার চোখে জল চলে এল। সেই শিশুকালের বন্ধু, যাকে ভেবেছিল আর কোনোদিন দেখবে না, আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বছরগুলো যেন তাদের মাঝখানে একটা অদৃশ্য প্রাচীর তুলে দিয়েছে।
ঋষি জানালার পাশে বসে বলল,
“তুমি এখন কী করো?”
“কলেজে পড়াই। বাংলা সাহিত্য।”
“তুমি লেখো এখনো?”
“না,” মীনা হেসে বলল, “লেখা মানে তো মনে রাখতে হয় কাকে নিয়ে লিখছি… আমি ভুলে যেতে চেয়েছিলাম।”
ঋষি আর কিছু বলল না। শুধু টেবিলের ওপর থাকা পুরনো কালি-দোয়াতে আঙুল ডুবিয়ে একটুখানি আঁকতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে বলল,
“তুমি জানো, আমি এখনো আঁকি — শুধু মানুষটা বদলে গেছে।”
সন্ধ্যায় মীনা বেরিয়ে এল পোস্টঅফিস থেকে। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসে কেমন একটা পুরনো দিনের গন্ধ। হঠাৎ মীনার মনে পড়ল সেই বাক্সটার কথা — চিঠির রোদে। সে স্থির করল, কালই যাবে নদীর ধারে, দেখে আসবে গাছটা এখনো আছে কি না।
পরদিন সকালে সে গেল নদীর তীরে। পানি এখন অনেক বেড়েছে, বাঁধের পাশে আগাছা। কিন্তু আশ্চর্য! সেই পুরনো গাছটা এখনো দাঁড়িয়ে, কাণ্ডে খোদাই করা — “ঋ ♥ মী”।

তার চোখে জল চলে এল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলা —
“তুমি এখানে?”
ঋষি দাঁড়িয়ে। হাতে একটা খাম।
সে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম এটা তোমার প্রাপ্য।”
মীনা অবাক হয়ে খামটা নিল। খুলতেই ভেতর থেকে বেরোল একটা হলুদ চিঠি — সেই শৈশবের চিঠিটা!
মীনা হতবাক।
“তুমি এটা রেখেছিলে?”
ঋষি মৃদু হেসে বলল,
“যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিনই বুঝেছিলাম — এই চিঠিটা আমি হারালে, তোমাকেও হারাবো। তাই এত বছর ধরে রেখেছি।”
মীনা নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে রইল। চারপাশে শুধু নদীর ঢেউয়ের শব্দ। কিছুক্ষণ পর বলল,
“আমরা কি আবার শুরু করতে পারি?”
ঋষি একটু থেমে বলল,
“জীবন আমাদের অনেক দূরে নিয়ে গেছে, মীনা। আমি এখনো তোমাকে ভাবি, কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“আমি বাগদান করেছি,” ধীরে বলল ঋষি, “দু’মাস পর বিয়ে।”
মীনা কিছু বলল না। নদীর জল হঠাৎ যেন আরও ভারী হয়ে গেল। দূরে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেল। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল,
“তবুও, ধন্যবাদ… তুমি চিঠিটা রেখেছিলে।”

ঋষি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। চোখে জল এসে গেল দুজনেরই। তারপর নিঃশব্দে তারা হাঁটতে লাগল নদীর ধারে, ঠিক যেমন ছোটবেলায় হাঁটত, কিন্তু এবার একসাথে নয় — সমান্তরাল দুটি পথ ধরে।
রাতের শেষে মীনা বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার লিখতে বসে গেল।
লিখল —
“ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, শুধু রূপ বদলে যায়। কেউ রেখে যায় চিঠি, কেউ রেখে যায় স্মৃতি।”
বাইরে তখন ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে, যেন প্রকৃতিও কাঁদছে চিঠির রোদের শেষ পাতায়।
ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, শুধু রূপ বদলে যায়………
তৃতীয় ও শেষ পর্ব আসছে খুব শীঘ্রই…..
Do Subscribe…….
